মেহেজাবীন ইসলাম-ফেনী প্রতিনিধি
ফেনীতে ২০২৪ সালের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি শুকাতে না শুকাতে আবারও সেই বন্যার মুখোমুখি হলো ফেনীবাসী। এবারের ভয়াবহ বন্যায় ফুলগাজী-পরশুরামের মানুষের সময় কাটছে চরম অনিশ্চয়তায়।
জানা গেছে, আজ বুধবার (৯ জুলাই) ফাটল অংশে কিছু কিছু জায়গা ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে সকালে ফুলগাজী বাজার হাঁটু পানির নিচে চলে যায়। বাজারের পূর্বাংশে প্রায় সব দোকানে পানি উঠে মালামাল নষ্ট হয়েছে।
চোখের সামনে পশুরামের পশ্চিম অলকা আলতাফ আলী চৌধুরী বাড়ির মাসুম চৌধুরীর ২টি বসতঘর পানির স্রোতে নিয়ে যায়। তিনি জানান, হঠাৎ করে কিছু বোঝার আগেই পানির এমন স্রোত বসতঘরের নিচের মাটিসহ নিয়ে যায়। গত বছর প্রবল বন্যায় ঠিক এভাবে আমার ঘরটি পানির স্রোতে নিয়ে যায় অনেক কষ্ট করে আবার সেই ঘরটি তৈরি করি কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। আমি নিঃশেষ হয়ে গেলাম। আমার পরিবার নিয়ে বাঁচার কোনো পথ দেখছি না।
ভারতের উজানের পানির স্রোতের মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর ১৪টি স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এবং মুহুরী নদীর আরো ৪টি স্থানে বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে ফুলগাজী ও পরশুরামের প্রায় ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ফুলগাজী সদরে নিলখী, দেরপাড়া, গোসাইপুর, শ্রীপুর, মুন্সিরহাট, বরইয়া, মনতলা, গাবতলা ও নোয়াপুর আর পরশুরাম উপজেলার উত্তর ধনীকুন্ডা, মধ্যম ধনীকুন্ডা, রামপুর, দুর্গাপুর ও রতনপুর প্লাবিত হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া পশুরামের বল্লারমুখায় অসমাপ্ত বাঁধের ভারতের অংশ ভেঙে উজানের পানি বাংলাদেশের ঢুকছে। ফলে কানকাতিয়াপুর গ্রামের আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় সিলোনিয়া নদীর মির্জানগর ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে বাঁধের ফাটল ধরেছে।
ফুলগাজী পরশুরাম ও দাগনভুঞা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলমান অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা বাতিল করে বন্ধ ঘোষণা করেন। এ ছাড়া সোনাগাজী উপজেলা নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেন উপজেলা প্রশাসন।
পরশুরাম উপজেলার ইউএনও আরিফুর রহমান জানান, মাঠ পর্যায়ে থেকে সার্বক্ষনিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙনের ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
পরশুরামের চিথলিয়া এলাকার বাসিন্দা জাকিয়া আক্তার জানান, রাত ৮টার দিকে ঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। এক পর্যায়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি। গেল বন্যায় সব জিনিস হারিয়েছি। ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আবারও স্বপ্ন ডুবেছে পানিতে।
মির্জানগর ইউনিয়নের পূর্ব রাঙামাটিয়া এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, পাউবোর কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে বল্রারমুখা বাঁধের প্রবেশ মুখটি বন্ধ করা হয়নি। সময মতো বাঁধের এ স্থানটি বন্ধ করা হলে পানি ঢোকার সুযোগ ছিল না। প্রতি বছরই কিছু মানুষের দায়সারা কাজের কারণে বড় একটি জনগোষ্ঠীর ভোগান্তি পোহাতে হয়।
ফুলগাজী উপজেলা ইউএনও ফাহরিয়া ইসলাম বলেন, উপজেলায় তিনটি নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৬টি স্থানে ভাঙ্গনের তথ্য পেয়েছি। এরই মধ্যে শতাধিক মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হয়েছে।’
ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আকতার হোসেন মজুমদার দৈনিক প্রতিদিনের কাগজকে জানান, মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ১২.৫৫ মিটার। মঙ্গলবার রাত ১১টায় সর্বশেষ ১৩.৯২ মিটার উচ্চতায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়। অর্থাৎ বিপৎ সীমার ১.৩৭ মিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির ফলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ভাঙন এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাসহ ঠিকাদারেরা ভাঙন এলাকায় জিও ব্যাগসহ মেরামতের কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি জানান। তবে এলাকাবাসীকে সর্তকতা অবলম্বন করেন এবং বাঁধের ভাঙনরোধে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ জানান।
এদিকে জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম ও ফেনীর পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান রাতে ফুলগাজী ও পরশুরামের প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের জানান, মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থা রয়েছে। দুর্যোগকবলিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে জেলা প্রশাসনের একটি টিম সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে। বন্যায় কবলিত মানুষের আশ্রয়ণের জন্য জেলা প্রশাসনের নির্দেশে ১৩১টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। দুর্গতদের জন্য শুকনো খাবার ও রান্না করা খাবারের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
মুহুরী নদীর পাড়ে ওপর দিয়ে উজানের বন্যা পানি প্রবাহিত হয়ে লোকালয়ে ঢুকে যাওয়ায় ছাগলনাইয়া উপজেলা সদরসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ দিকে ফুলগাজী বক্সমাহমুদ সড়ক ৪ ফুট নিচে তলিয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
এদিকে ফেনী শহরের জলাবদ্ধতায় জমে থাকা পানি নামতে শুরু করেছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত শহরের অনেক দোকানের মধ্যে পানি দেখা গেছে। শহরের জলাবদ্ধতার কারণ ও প্রতিকারের জন্য পৌরসভার কর্মকর্তাদের নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপ- পরিচালক ও পৌর প্রশাসক গোলাম মো. বাতেন বৃষ্টির মধ্যে প্লাবিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘শহরের জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হচ্ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, ড্রেনেজ সিস্টেম পরিকল্পনার অভাব, ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার না থাকা। ইতিমধ্যে তা আমরা কর দিয়েছি। তরে শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।’
জানা যায়, শহরের পানি কমলেও জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম উপজেলায় উজানের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আসা শুরু করেছে। এ ছাড়াও ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলায় নিন্মাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির স্বেচ্ছাসেবক দলগুলো বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে।